
সাগর দেব,কুমিল্লা প্রতিবেদকঃ মোঃ কাউছার হামিদ জন্মগ্রহণ করেন বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার ঐতিহ্যবাহী ও সমৃদ্ধ অঞ্চল ময়নামতিতে। তাঁর জন্ম এক শান্ত, ধর্মভীরু ও নীতিনিষ্ঠ পরিবারে, যেখানে মানুষকে ভালোবাসা, সহানুভূতি ও দায়িত্ববোধ শেখানো হতো ছোটবেলা থেকেই। তিনি ছিলেন পরিবারের আদরের সন্তান এবং ছোট থেকেই মানবিক গুণাবলির প্রকাশ ঘটিয়েছেন। বিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি সহপাঠীদের প্রতি তাঁর সহযোগিতা, শিক্ষকদের প্রতি সম্মান এবং সমাজের বিভিন্ন ছোটখাটো উদ্যোগে অংশগ্রহণ তাঁর নেতৃত্বের গুণাবলিকে প্রকাশ করতে শুরু করে।
ছাত্রজীবনে মোঃ কাউছার হামিদ সবসময় মেধা ও মননের সমন্বয় ঘটিয়েছেন। শুধু পাঠ্যবইয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেননি, বরং স্কুল ও কলেজে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমেও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। শিক্ষকরা তাঁকে একজন পরিশ্রমী, সৎ ও নিষ্ঠাবান শিক্ষার্থী হিসেবে মনে রাখতেন। এই সময় থেকেই তাঁর ভেতরে এক ধরনের দায়বদ্ধতা জন্ম নেয়—সমাজের জন্য কিছু করার, অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর, আর ভবিষ্যতে এমন একটি পথ গড়ার যা হবে মানুষের কল্যাণে উৎসর্গীকৃত।
জীবিকার প্রয়োজনে এবং পরিবারের স্বচ্ছলতা নিশ্চিত করার জন্য মোঃ কাউছার হামিদ পরবর্তীতে পাড়ি জমান মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কুয়েত-এ। প্রবাস জীবন কোনোদিনই সহজ নয়। একা, দূরে, ভাষার ও সংস্কৃতির ভিন্নতায় প্রতিদিনের জীবনে যেসব বাধা পেরিয়ে যেতে হয়, সেসবের মধ্যেও তিনি নিজের আত্মবিশ্বাস ও মানবিকতা হারাননি। তিনি কুয়েতে কাজের পাশাপাশি গভীরভাবে অনুভব করতে থাকেন প্রবাসীদের দুর্ভোগ—চাকরিচ্যুতি, আর্থিক সংকট, চিকিৎসাসেবা না পাওয়া, আইনি জটিলতা ইত্যাদি। সেই অভিজ্ঞতাই তাঁকে অনুপ্রাণিত করে একটি বৃহত্তর চিন্তার দিকে: “প্রবাসীদের নিয়ে একটি সংগঠন গড়ে তুলতে হবে, যার মাধ্যমে সমাজ এবং মানুষ উপকৃত হবে।”
২০২০ সাল—বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারির ভয়াল থাবায় থমকে গিয়েছিল মানবসভ্যতা। বাংলাদেশের প্রবাসীরা তখন ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিলেন—চাকরি হারানো, চিকিৎসা না পাওয়া, মৃতদেহ দেশে ফেরানোর কষ্টকর প্রক্রিয়া। এমন সময় মোঃ কাউছার হামিদ প্রতিষ্ঠা করেন ময়নামতি প্রবাসী কল্যাণ সংস্থা। তিনি সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নেন। এই সংস্থার লক্ষ্য ছিল, বিশ্বের যেখানেই প্রবাসী বাঙালি থাকুক না কেন, তাদের পাশে দাঁড়ানো এবং দেশে থাকা অসহায়, গরীব, দুস্থ মানুষদের সহায়তা করা।
এই সংগঠন গঠনের পেছনে তাঁর মূল বিশ্বাস ছিল—”একটি সংগঠনের শক্তি তখনই পূর্ণ হয়, যখন সেটি মানুষের চোখের পানি মুছতে পারে।” তিনি চাননি এটি হোক আরেকটি আনুষ্ঠানিক সংগঠন মাত্র। বরং এটি হয়ে উঠুক মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জীবন্ত হাত।
ময়নামতি প্রবাসী কল্যাণ সংস্থা শুরু থেকেই কিছু ব্যতিক্রমী এবং জরুরি মানবিক উদ্যোগ গ্রহণ করে। দেশে দুস্থ পরিবারদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ, মেডিকেল সহায়তা, অসহায় পরিবারের দাফন কার্যক্রমে সহযোগিতা, অর্থনৈতিক অনুদান, শীতবস্ত্র বিতরণ, রক্তদান কর্মসূচি, এবং শিক্ষার্থীদের জন্য সহায়তা তহবিল—এই সবকিছুই তিনি ও তাঁর সংগঠনের সদস্যরা নিষ্ঠার সঙ্গে বাস্তবায়ন করে আসছেন।
বিশেষ করে করোনাকালে যখন অনেক প্রবাসী খাবার কিংবা ওষুধের জন্য হাহাকার করছিলেন, তখন মোঃ কাউছার হামিদ নিজের হাতে তা পৌঁছে দিয়েছেন। এভাবে একে একে কুয়েতে অবস্থানরত বাংলাদেশি প্রবাসীদের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়ে। সবাই তাঁকে জানেন এক নিবেদিতপ্রাণ সমাজসেবক হিসেবে।
মোঃ কাউছার হামিদের অন্যতম বড় গুণ হচ্ছে তাঁর সৎ, নিরহংকারী এবং নেতৃত্বগুণসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। তিনি বিশ্বাস করেন, নেতৃত্ব মানেই শুধু নির্দেশ দেওয়া নয়, বরং নিজে সামনে থেকে কাজ করে দেখানো। সমাজসেবাকে তিনি কখনোই “দানের বিষয়” হিসেবে দেখেন না। তাঁর দৃষ্টিতে, এটা দায়িত্ব, এটা কর্তব্য।
তাঁর সংগঠনের সদস্যরা জানান, তিনি কখনো কাউকে ছোট করেন না, সকলের মতামত গুরুত্ব দেন, প্রয়োজনে নিজেই একাধিক কাজ হাতে তুলে নেন। এসব গুণই তাঁকে একজন আদর্শ নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
মোঃ কাউছার হামিদ অত্যন্ত পারিবারিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ। তিনি সবসময় তাঁর মা-বাবা ও পরিবারের আদর্শকে সম্মান করে চলেছেন। সম্প্রতি তিনি তাঁর প্রিয় মাকে হারান। এই শোক তাঁকে ভীষণভাবে স্পর্শ করে। নিজের অনুভূতিতে তিনি বলেন, “আমার মা ছিলেন আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। তিনি আমাকে শিখিয়েছেন কিভাবে মানুষকে ভালোবাসতে হয়, কিভাবে বিনিময় ছাড়াই মানুষের পাশে থাকতে হয়।”
মায়ের মৃত্যু তাঁকে কিছু সময়ের জন্য স্থবির করে দেয়, কিন্তু এই শোককে শক্তিতে রূপান্তর করে তিনি আবারো নতুন উদ্যমে সমাজসেবার কাজ শুরু করেন। মা যেন তাঁর হৃদয়ে একটি আলোকবর্তিকা হয়ে থাকেন চিরকাল।
মোঃ কাউছার হামিদের স্বপ্ন সীমাবদ্ধ নয়। তিনি চান তাঁর সংগঠন শুধু কুয়েত বা কুমিল্লা নয়, বরং বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় মানুষের কল্যাণে কাজ করুক। তিনি ভবিষ্যতে একটি স্থায়ী ফাউন্ডেশন গঠন করতে চান, যেখানে থাকবে—
১.গরীব শিক্ষার্থীদের জন্য স্থায়ী বৃত্তি ব্যবস্থা
২.প্রবাসীদের জন্য আইনি ও মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা সেল
৩.দুঃস্থ রোগীদের জন্য ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প
৪.অনলাইন হেল্প ডেস্ক, যেখানে যেকোনো প্রবাসী সেবা চাইতে পারবেন
তাঁর ইচ্ছা, মৃত্যুর পর যেন মানুষ তাঁকে মনে রাখে একজন সেবক হিসেবে, একজন প্রিয়ভাজন ভাই হিসেবে—যিনি চেয়েছিলেন মানুষের চোখের অশ্রু মুছিয়ে দিতে।
মোঃ কাউছার হামিদ কুয়েতে অবস্থান করেও বাংলাদেশের জন্য, মানুষের জন্য, সমাজের জন্য এক নিরলস যোদ্ধার মতো কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি শুধু একজন সংগঠক নন, একজন মানবিক নেতা। তাঁর জীবনকাহিনী আমাদের শেখায়, ভালোবাসা, দয়া আর দায়িত্ববোধের মাধ্যমে একজন মানুষ কিভাবে সমাজের ভরসাস্থলে পরিণত হতে পারেন।
এই যুগে যখন অনেকেই শুধু নিজের নিয়ে ভাবেন, তখন কাউছার হামিদ প্রমাণ করেছেন—এখনো কিছু মানুষ আছেন যারা সত্যিই “মানুষ”। তিনি জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে এই বার্তাই ছড়িয়ে দিয়েছেন—”মানুষের জন্য বাঁচো, তবেই জীবন সার্থক।
মন্তব্য লিখুন
আরও খবর
আখাউড়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এমসি বাণিজ্য: রোগীর কাছ থেকে...
আখাউড়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এমসি বাণিজ্য: রোগীর...
সমাজসেবার এক অনবদ্য নেতা-মাসুদুর রহমান
সমাজসেবার এক অনবদ্য নেতা-মাসুদুর রহমান
ভারতে ছয় ধরণের পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ: আখাউড়া স্থলবন্দরে...
ভারতে ছয় ধরণের পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ:...
আখাউড়ায় লিচু গাছ থেকে পড়ে ১ যুবকের মর্মান্তিক...
আখাউড়ায় লিচু গাছ থেকে পড়ে ১...
আখাউড়ায় জেলা বিএনপির নবনির্বাচিত নেতাদের গণসংবর্ধনা ও আনন্দ...
আখাউড়ায় জেলা বিএনপির নবনির্বাচিত নেতাদের গণসংবর্ধনা...
বকেয়া বেতনের দাবিতে টঙ্গীতে শ্রমিকদের সড়ক অবরোধ
বকেয়া বেতনের দাবিতে টঙ্গীতে শ্রমিকদের সড়ক...